বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাংবাদিকদের সম্পৃক্ততা দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশেষ করে, কোনো সাংবাদিক যখন সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে পদ গ্রহণ করেন, তখন তার পেশাগত নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সংবাদমাধ্যমের কর্মী হিসেবে থেকেও কেউ যদি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সেটি সাংবাদিকতার মৌলনৈতিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।
এই বাস্তবতায়, একটি বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ প্রস্তাব হতে পারে—রাজনৈতিক দলগুলো সাংবাদিকদের সরাসরি পদ না দিয়ে ‘পাবলিক রিলেশন অফিসার (পিআরও)’ বা ‘মিডিয়া সেল’-এর দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া। এতে করে সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দলের দোসর কিংবা তৃতীয় শক্তি হিসেবে বিবেচিত হবেন না, মিথ্যা মামলা কিংবা হয়রানির শিকারও হবেন না। দলীয় ক্ষমতার পরিবর্তনে পালিয়ে বেড়াতে হবে না কিংবা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না।
বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট’, ‘পিআর কনসালটেন্ট’ কিংবা ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজার’ পদে নিয়োজিত থাকেন যাঁরা পেশাদারভাবে দলীয় যোগাযোগের কাজ করেন। বাংলাদেশেও যদি একইভাবে সাংবাদিকদের পেশাদার দায়িত্বে যুক্ত করা যায়, তবে রাজনৈতিক দল এবং গণমাধ্যম—উভয়েরই মর্যাদা বজায় থাকবে।
সমাধান প্রস্তাব (মূল প্রস্তাবনাসমূহ):সাংবাদিকদের রাজনৈতিক দলের পদ না দিয়ে ‘পিআরও’ বা ‘মিডিয়া সেলের দায়িত্বে’ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
নিয়োগ হবে চুক্তিভিত্তিক ও নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য, কেন্দ্র ও জেলা-উপজেলা শাখা অনুযায়ী।
নিযুক্ত সাংবাদিকরা মাসিক সম্মানী বা নির্ধারিত ভাতা পাবেন।
তাদের কাজ থাকবে:দলের পক্ষে মিডিয়ায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রেরণ, দলীয় কর্মসূচি কাভার করতে মিডিয়াকে সহযোগিতা প্রদান, দলের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা।
এভাবে কাজ করলে সাংবাদিকতা পেশার নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় থাকবে। একইসঙ্গে দলগুলোও একটি পেশাদার ও সুশৃঙ্খল মিডিয়া কাঠামোর আওতায় আসবে।
আমরা দেখতে পেয়েছি, বর্তমান এবং বিগত সরকার আমলে বহু সাংবাদিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরাসরি দলে পদ গ্রহণ করেছেন। এর ফলে তারা নিজেদের পেশাগত দায়িত্বে সন্দেহের চোখে পড়েছেন, এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আক্রোশের শিকার হয়েছেন। অনেকে হামলা-মামলা, চাকরি হারানো, কিংবা সংবাদমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে পেশাগত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন।
প্রথম আলো পত্রিকার উদাহরণই যথেষ্ট। ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি একাধিকবার সরকারের রোষানলে পড়েছে, বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে, মামলা হয়েছে, এমনকি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়েছে। প্রথম আলো ছাড়াও নয়াদিগন্ত, ইসলামিক টিভি, এবং সাম্প্রতিক সময়ে ভোরের কাগজ-এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া—এ সবই দেশের মিডিয়ার ওপর রাজনৈতিক চাপের জোরালো প্রমাণ।
এখন রিপোর্ট, সংবাদ বা মতামত—সবকিছুই রাজনৈতিক বয়ানের চশমায় যাচাই করা হচ্ছে। “সত্য বললে শত্রু, প্রশংসা করলে তোষামোদ”—এই ধারণা এখন গণমাধ্যমকে আরও সংকটে ফেলছে। ফলে সাংবাদিকতা আর কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণের জায়গায় নেই, বরং রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার অংশ হয়ে উঠছে।
এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে সাংবাদিকতা পেশায় মেধাবী ও দায়িত্বশীল মানুষের অনাগ্রহ সৃষ্টি হবে। পেশাটি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে, যা গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহিতার জন্য ভয়ানক হুমকি।
সাংবাদিকতা ও রাজনীতি—এই দুই ভিন্ন পেশাকে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে আলাদা রাখা গেলে গণতন্ত্র, সুশাসন, সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি—সবই লাভবান হবে বলে আমরা মনে করি।
এমন একটি প্রস্তাবনার বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারক, গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক সংগঠন এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ও সুশীল সমাজ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
Leave a Reply